স্বপ্নের ইউরোপ যেতে জীবন বাজি রাখছেন সিলেটিরা

সিলেট ভিউজ ডেস্ক: লাল-সাদা রঙের উদ্ধার জাহাজটি নিয়মিত ভূমধ্যসাগরে বিশাল এলাকা চষে বেড়ায়। জাহাজটি থেকে সেদিন হঠাৎ দূরে চোখে পড়লো বাতাসে ফোলানো নীল রংয়ের একটি রাবারের নৌকা। ভেতরে গাদাগাদি করে মানুষ, তাদের মাথাগুলো ঢেউয়ে উঠানামা করছে। জাহাজে উপস্থিত ত্রাণ সংস্থা এসওএস মেডিটেরানির কর্মীরা দ্রুত মাথায় হেলমেট এবং লাইফ জ্যাকেট পরে ফেললো। কয়েকটি স্পিড বোটে উঠে তারা ঐ রাবারের নৌকাটির দিকে ছুটে গেল। তারপর এক এক করে নৌকার অভিবাসীদের স্পিডবোটে তুলে জাহাজে উঠালো। তাদের অধিকাংশই কিশোর-তরুণ। সিংহভাগই গাম্বিয়া থেকে আসা। কয়েকজন আছেন সিলেটেরও। ত্রিপলির কাছে লিবিয়ার উপকূলীয় শহর কাসটেলভার্দে শহর থেকে ১৫ ঘণ্টা আগে নৌকায় রওয়ানা দিয়ে ৫৪ নটিক্যাল মাইল এগিয়েছে। সবাই ক্লান্ত, অবসন্ন। তাদের কজন আমাকে জানায় উদ্ধারের কিছুক্ষণ আগে নৌকার ভেতর বড় ধরনের মারামারি লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কেউ কেউ চাইছিল কপালে যাই ঘটে এগিয়ে যেতে হবে, বাকিরা চাইছিল এ-দফায় ফিরে গিয়ে আবার চেষ্টা করতে। ধস্তাধস্তির মধ্যে একজনের মোবাইল ফোন সাগরে পড়ে যায়। তাদের একজনের গায়ে ছিল ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের হালকা নীল টি-শার্ট। অনেকের হাতে আইফোন। কারো কারো হাতে পানির বোতল, প্যাকেট খাবার। নৌকার যাত্রীদের অনেকেই সাঁতার জানে না। তাদের সাথে রয়েছে গাড়ির টায়ারের ভেতরের ফোলানো অংশ, যাতে নৌকা যদি ডোবে, সেগুলো ধরে যেন ভেসে থাকা যায়। উদ্ধারকাজ চলার সময় তাদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কারণ- দূরে হঠাৎ চোখে পড়ে লিবিয়ার উপকূল-রক্ষী বাহিনীর একটি জাহাজ। এদের অনেককেই এর আগে লিবিয়ার কোস্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়ে ফিরে যেতে হয়েছে। আফ্রিকা থেকে সাগর-পথে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিবিয়ার কোস্ট গার্ডকে জাহাজ, টাকা-পয়সা এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছে। উদ্ধারের জন্য যাওয়া স্পিড বোটে উঠে বেশ ক’জন তরুণের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। একজন সেলফি তুলে ফেললো। তাদের একজন পরে আমাকে বলেছে- একজন উদ্ধারকারীর হাত ধরার পর তার মনে হয়েছিল, “আমি ইউরোপে ঢুকে গেছি। স্পিডবোটে করে এই অভিবাসী দলটিকে ওসান কিং নামের উদ্ধার জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে তাদের মেডিকেল পরীক্ষা হয়, তারপর নতুন একসেট জামা-কাপড় দেওয়া হয়। সেইসাথে দেওয়া হয় প্ল্যাস্টিকের একটি ব্যাগ যার ভেতর ছির টুথব্রাশ, টুথপেস্টের মতো জিনিস। এরপর উদ্ধার জাহাজটি ইটালির কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে তাদেরকে দেরি না করে দ্রুত বারি বন্দরে যাওয়ার কথা বলা হয়। বারি বন্দরে পৌঁছুতে প্রায় তিনদিন লাগে। জাহাজের ডেকে অভিবাসীদের থাকা এবং চিকিৎসার জন্য ঘরের মতো বেশ কটি অস্থায়ী কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোতে তাদের কয়েকজনের সাথে আমার কথা হয়। তাদের অনেকেই বেশ ইংরেজি বলতে পারে। তাদের যে নাম ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো ছদ্মনাম। এই অভিবাসীরা আমাদের কাছে স্বীকার করেছে যে এই যাত্রায় চরম ঝুঁকির কথা তারা জানতো। তাদের অনেকেই এর আগেও একাধিকবার ইউরোপ আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। অনেকে মরতে মরতে বেঁচে গেছে। লিবিয়ার উপকূল বাহিনী বা জেলে নৌকা তাদেরকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে গেছে। “আমি এ নিয়ে সাতবার চেষ্টা করেছি,” ১৭ বছরের এক তরুণ বললো। জানা গেলো- তাদের প্রত্যেকেরই পরিচিতি এবং বন্ধু-বান্ধবদের কেউ না কেউ ইউরোপে আসতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ক’দিন আগে গ্রিসের উপকূলের কাছে নৌকা ডুবে প্রায় ৭৫০ জনের মৃত্যুর খবরও তারা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছে। তারাও লিবিয়ার উপকূল থেকেই রওয়ানা হয়েছিল। একজন বলললেন- ঐ ঘটনায় সে তার সংকল্প থেকে সরেনি। “সবার মনোভাব এমন যে – হয় ইউরোপ পৌঁছুবে, না হয় সাগরে ডুবে মরবে,” ঐ তরুণ বলে, “বিকল্প এই দুটোই।“ তার দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রিসে ডুবে যাওয়া অভিবাসীরাও এই মনোভাব নিয়েই নৌকায় উঠেছিল। এসওএস মেডিটেরানি এই রাবারের বোটটির সন্ধান পায় ‘অ্যালার্ম ফোন’ নামে একটি জরুরি হেল্প-লাইনের মাধ্যমে যারা সাগরে দুর্গত অভিবাসী নৌকার খবর দেয়। ইউরোপীয় সীমান্ত এজেন্সি ফ্রনটেক্সও খবর দিয়েছিল। এই অভিবাসীদের ৮০ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের কম। তাদের সাথে কোনো অভিভাবক নেই। এদের অনেকেই লিবিয়া থেকে নৌকায় ওঠার কয়েক বছর আগেই পরিবার, দেশ ছেড়েছে। অনেকে বলেছে তাদের বাবা অথবা মা নেই, অথবা দু’জনের কেউই বেঁচে নেই। পরিবারের সন্তান হিসাবে প্রিয়জনদের দেখভাল করার জন্য ইউরোপে গিয়ে আয়ের তাড়না থেকে নিজের গ্রাম-শহর ছেড়ে এসেছে। ভূমধ্যসাগরের কেন্দ্রাঞ্চল ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনের প্রধান রুট। ফ্রনটেক্স জানিয়েছে এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নৌকা দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দেওয়া লোকের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫০,৩১৮। এই সংখ্যা ২০১৭ সালের পর সবচেয়ে বেশি। এসব অভিবাসীর সবাই যে আফ্রিকার নাগরিক তা নয়। বাংলাদেশ- বিশেষ করে দেশের সিলেট অঞ্চলসহ দক্ষিণ এশিয়া, ইরান এবং আফগানিস্তান থেকেও বহু মানুষ লিবিয়া হয়ে এই রুটে ইউরোপে আসার চেষ্টা করে। আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন পথে এরা লিবিয়ায় পৌঁছে। মানব পাচারকারীদের পয়সা দিয়ে অনেক সময় কয়েকটি দেশ পার হতে হয় তাদের। তীরে পৌঁছুনোর আগে এই অভিবাসী কিশোর তরুণরা জাহাজের ডেকেই ফুটবল খেলেছে, তাস খেলেছে, লাউডস্পিকারে সঙ্গীতের তালে নাচানাচি করেছে। নিজেদের আনা কাপড়চোপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে জাহাজের ওপরই শুকালো তারা। লিবিয়ায় তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তারা জানায়, নৌকায় ওঠার আগের বেশ কিছুদিন তারা পাচারকারীদের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ক্যাম্পে ছিল। নৌকায় ওঠার জন্য একেক জনকে ৩,৫০০ লিবিয়ান দিনার (৫৭০ পাউন্ড) দিতে হয়েছে।

 

আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker